মাযহাব কী ও কেন? বুঝি সহজ ভাষায় অল্প কথায়

মাযহাব

এই লেখায় মাযহাব সম্পর্কিত প্রায় সমস্ত প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। মাযহাব শব্দের অর্থ কী? মাযহাব মানা কি ফরজ? মাযহাব অনুসরণ করার হুকুম কী?

সমস্ত উত্তর লেখা হয়েছে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে। যাদের ধর্মীয় বিষয়ে তেমন ধারণা নেই, তারাও এই আলোচনার মাধ্যমে মাযহাব সম্পর্কে সুস্পষ্ট একটি ধারণা পেয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ্‌।

বিষয়বস্তু হিসেবে লেখাটি খুবই বড় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সাধারণ পাঠকদের দিকে লক্ষ্য করে আমি আলোচনাটিকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি এবং শুধুমাত্র সেই আলোচনাগুলোই আনার চেষ্টা করেছি, যেগুলো না হলেই নয়।

 


ডাক্তারের কর্মপন্থা আমাদের সকলেরই জানা। ডাক্তাররা প্রথমে রোগের কথা শুনেন। তারপর ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন। তাছাড়া বড়জোর দু’তিনটা উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়া ব্যতিত ভিন্ন কোন কথা বলেন না তারা।
বলেন না, ‘আপনার যে রোগ হয়েছে, সেই রোগ সম্পর্কে প্রথম জানা যায় এত সালে। পূর্বেকার যুগের লোকেরা এই রোগের চিকিৎসা করত এভাবে। এই রোগের এই এই পর্যায় রয়েছে এবং এই এই পর্যায়ের জন্য দেওয়া হয় এই এই ঔষধ।’
‘রোগ সম্পর্কিত হলেও কেন এই সকল তথ্য দেন না ডাক্তার? ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেওয়া ঔষধ কীসের ভিত্তিতে দিয়েছেন তিনি?’ এই সকল প্রশ্ন করা হয় না কখনো।
কারণ আমরা জানি, রোগীর উপর ইহসান বা দয়া করেই এই জ্ঞানের বোঝা চাপিয়ে দেন না ডাক্তার।
যদি দিতেন তাহলে যা ঘটতঃ
*অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হত ডাক্তারের।
*এই তথ্য জানার দ্বারা রোগীরও কোন উপকার হত না।
*এত বিষয় বলতে গেলে কিংবা লিখতে গেলে ডাক্তারের কাছে আসার মূল উদ্দেশ্যই রোগীর জন্য ব্যর্থ হয়ে যেত। ডাক্তার তাকে মূল কী পরামর্শ দিলেন বা ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন সেটি তার আর বুঝে আসত না।
মূল বিষয়টাকে সহজে উপস্থাপনের জন্যই এই কথাগুলো লিখা।
আল্লাহ মানবজগতে বিভিন্ন স্তর তৈরি করে দিয়েছেন। যাতে এরা পরস্পর নির্ভরশীল হয় এবং একে অপরের দ্বারা উপকৃত হতে পারে। তাই কেউ ধনী, কেউ গরীব। কেউ শিক্ষিত, কেউ মূর্খ। কেউ শক্তিশালী, কেউ দুর্বল ইত্যাদি।
আল্লাহ তায়ালা জানেন, পৃথিবীর সবাই ইলমে দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারবে না। তাই তিনি সকল মানুষকে আদেশ দেননি এই মহৎ কাজটি করার। বরং বলেছেন, কিছু মানুষ যেন আসমানী ইলম হাসিলের জন্য বের হয়, ইলমে দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করে আর ফিরে এসে মানুষকে সতর্ক করে জাহান্নামের রাস্তা থেকে, পরিচালিত করে সুপথে। (সূরা তাওবাহ -১২২)
আর যারা অজ্ঞ তাদের আদেশ দিয়েছেন এই আলেমদের থেকে জেনে নিতে। (সূরা নাহল -৪৩ এবং সূরা আম্বিয়া -৭)
তাই জনসাধারণ আসে আলেমদের কাছে। জেনে নেয় তাদের প্রয়োজনীয় ধর্মীয় বিষয়। ‘কিভাবে অযু করবে? কিভাবে নামায পড়বে? কি করলে রোযা ভেঙ্গে যায়?’ ইত্যাদি।
আলেমরাও সহজ ভাষায় তাদেরকে ধর্মীয় বিষয়গুলো বলে দেন। তবে প্রয়োজন না পড়লে উল্লেখ করেন না কোন কোন দলিলের ভিত্তিতে বের হয়েছে এই মাসআলা।
যারা বুঝেন যে, ডাক্তার রোগীকে কেন রোগ সম্পর্কিত সব তথ্য দেন না, তারা এটাও বুঝবেন যে আলেমরা কেন সহজভাবে জনসাধারণকে মাসআলা বলে দেন এবং তার দলিল-প্রমাণগুলো উপস্থাপন করেন না।

যদি দিতেন তাহলে কী ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়াত! সেটা নিয়ে কি আমরা চিন্তা করেছি?

মনে করি, এক জন সাধারণ মানুষ অযুর মাসআলা শিখতে আসলেন আলেমের কাছে। আলেম তাকে বলা শুরু করলেন, ‘অযু সম্পর্কে কোরআন কারীমের এই এই আয়াতে বলা হয়েছে। এই এই হাদীসের কিতাবে এই এই হাদীসে অযু সম্পর্কিত বর্ণনা রয়েছে। হাদীসগুলোর মান এমন এমন। এই হাদীসে রাসুল্লাহ সা. আদেশ দিয়েছেন সুন্নাত বুঝানোর জন্য, এই হাদীসে মুস্তাহাব বুঝানোর জন্য।’ এমনভাবে যদি আলেম আলোচনা শুরু করেন তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াবে? লোকটি মনে মনে বলবে, ‘এক অযুর মাসআলা জানতেই এই অবস্থা। তাহলে আর নামায পড়ব কীভাবে?’
উম্মতের উপর আলেমরা বড় ইহসান করেছেন। তাদের কারণেই জনসাধারণ বেঁচে গেছে এই কষ্টকর কর্মপন্থা গ্রহণ করা থেকে। তারা সহজভাবে জানতে পারছে আমলের পদ্ধতিগুলো এবং এর মাধ্যমে চলার চেষ্টা করছে হেদায়েতের পথে।
কিন্তু কেউ যদি অপব্যখ্যা করে এই কর্মপন্থার? ইহসানমূলক এই সুন্দর কর্মপন্থা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায় মানুষের মনে?
প্রথমে ডাক্তারের কথা আলোচনা করা হয়েছিল। তাদের বিষয়ে কিন্তু কখনো এই প্রশ্ন করা হয় না যে, ‘কীসের ভিত্তিতে ডাক্তার এই ঔষধ দিলেন’? কিংবা তাদের সম্পর্কে বলা হয় না যে, তারা না জেনেই ঔষধ দিচ্ছেন।
তাহলে এই প্রশ্ন তোলা কি বোকামি নয়, ‘আলেমরা কীসের ভিত্তিতে মাসআলা বলেন? কিংবা বোকামি নয় এটা বলা যে, ‘আলেমরা দলিল প্রমাণ ছাড়াই কোন মাসআলা বলে দেন।’
বর্তমান সমাজে একটি ফিতনা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। দ্বীনী বিষয়ে এই ফিতনা যারা ছড়াচ্ছে তাদের অধিকাংশই অজ্ঞ দ্বীন সম্পর্কে। অথচ তাদের আচার-ব্যবহারে প্রকাশ পায় তারা বোধ হয় যমানার সবচেয়ে বড় আলেম।
তারা বিভিন্ন নামে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে। কখনো ‘আহলে হাদিস’, কখনো ‘সালাফি’, কখনো ‘শুধু মুসলিম’ ইত্যাদি নামে।
তারা জনসাধারণকে বলছে, ‘আলেমরা তোমাদের যেসব মাসআলা বলে থাকে, সেগুলো তাদের মনগড়া। তাদের পক্ষে কোরআন-হাদীসের কোনো দলিল নেই।’
তারা নিজেরা যেমন ভ্রান্ত, তেমনই প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে জনসাধারণকে। আর এই বিভ্রান্তি ছড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র কিছু আজগুবি প্রশ্ন। যেইগুলো বাহ্যিকভাবে বেশ জটিল মনে হলেও বাস্তবে সেগুলো কোন প্রশ্নের পর্যায়েই পড়ে না।
তাদের প্রশ্নের কিছু নমুনাঃ ‘তুমি হানাফী নাকি মোহাম্মদী? যদি আবু হানিফার কথা মেনে চলে তাহলে হানাফী আর নবীজি সা. এর কথা মানলে মোহাম্মদি।’
অথবা ‘কোরআন-হাদীস মানবে নাকি ফিকাহ (মাযহাব) মানবে?’
যারা এই সকল প্রশ্ন করে, তারা আসলে দ্বীনি বিষয়ে কোন ধারণাই রাখে না। ইন্টারনেট কিংবা টিভি শায়েখদের মুখে তারা এগুলো শুনে। আর না বুঝেই তোতাপাখির মতো এই সকল বুলি আওড়াতে থাকে।
যদি তারা বুঝত, এই সকল প্রশ্ন কতটা হাস্যকর , তাহলে তারা কখনোই এই সকল প্রশ্ন মুখে আনত না।

মাযহাব কী?

মাযহাব শব্দের অর্থ পথ, পন্থা।

এটা কি কোরআন হাদিসের বাহিরের কিছু? কোনভাবেই না। বরং কোরআন হাদীস মেনে চলার সুন্নাহসম্মত পন্থাই হল মাযহাব।
কোরআন হাদিসে হুকুম আহকাম সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো দুই ধরনের। কিছু সুস্পষ্ট আর কিছু সাধারণ মানুষদের জন্য অস্পষ্ট। যে সকল আয়াত সুস্পষ্ট। যার অর্থ ও মর্ম সবাই বুঝে সে সকল ক্ষেত্রে আমরা কোন মাযহাবের অনুসরণ করি না। আর এই সকল বিষয়ে কোন মাযহাবের মধ্যে মতপার্থক্যও নেই। যেমন, নামায পাঁচ ওয়াক্ত, নামাযের জন্য পবিত্রতা আবশ্যক ইত্যাদি।
কিন্তু কিছু আয়াত ও হাদীস আছে যার অর্থ ও মর্ম সুস্পষ্ট নয়। যার অর্থের ক্ষেত্রে একাধিক মত রয়েছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা একই বিষয়ে রয়েছে বিভিন্ন হাদীস, যার মধ্যে বাহ্যত বিরোধ পরিলিক্ষিত হয়।
যেমন, নিশ্চয় সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। এখানে হাদীসের উদ্দেশ্য কী? ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেছেন, এর উদ্দেশ্য হল, সমস্ত আমলের সওয়াব নির্ভরশীল নিয়তের উপরে। আর ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন এর উদ্দেশ্য হল, সমস্ত আমলের শুদ্ধতা নিয়তের উপর নির্ভরশীল। তাই কেউ যদি গোসলের সময় অযুর নিয়ত না করে তাহলে শাফেয়ী মাযহাব অনুসারে তার অযু হবে না। কিন্তু হানিফা মাযহাব মতে, তার অযু হয়ে যদিও সে অযুর সওয়াব পাবে না। একই হাদীস থেকে যে দুইটি অর্থ নেওয়া যায়, এটি তার উদাহরণ।
এখন, সাধারণ মানুষের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় একটি বিষয়ে সকল আয়াত ও হাদীস সামনে রেখে অস্পষ্টতা দূর করা, বাহ্যত বিরোধ যেখানে দেখা যায় সেখানে সামঞ্জস্যবিধান করা ইত্যাদি।
তাই তাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য বিজ্ঞ আলেমরা, যারা কোরআন-হাদীসের বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন, তারা এই মহৎ কাজটি করে দিয়ে গেছেন। তারা প্রথমে কোরআন-হাদীসের আলোকে কিছু মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন। তারপর সেই মূলনীতির আলোকে কোরআন-হাদীস থেকে মাসআলা বের করেছেন। তবে হ্যাঁ, মূলনীতি সব ইমামদের এক ছিল না। কারো মূলনীতি ছিল, মদিনাবাসীর আমলকে প্রাধান্য দেওয়া, কারো মূলনীতি ছিল হাদীসের বাহ্যিক অর্থকে প্রাধান্য দেওয়া ইত্যাদি। তেমনই কোরআন-হাদীসের ব্যাখ্যায় কেউ প্রাধান্য দিয়েছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর মতকে, আবার কেউ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর মতকে। আর এই রকম কিছু কারণেই ইসলামের আহকাম সম্পর্কিত শাখাগত বিষয়ে আলেমদের মতপার্থক্য দেখা যায়।
তবে এই মতপার্থক্যকে বিভক্তি বলার কোনো সুযোগ নেই। কেননা, বিভক্তি তখনই হত যদি তাদের মাঝে বিশ্বাসগত পার্থক্য হত অথবা এক মাযহাবের অনুসারীরা অপর মাযহাবের অনুসারীদের ভ্রান্ত মনে করত। বরং তারা বলেন, ‘এখানে দুইটি মত রয়েছে। আমরা দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে এই মতটা গ্রহণ করেছি। আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা সঠিক মনে করি তবে ভুলও হতে পারে। অপর মাযহাবের সিদ্ধান্ত ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশী তবে সঠিকও হতে পারে।’
আর এ মতপার্থক্য মিটে যাওয়া অসম্ভব। কেননা, কোরআন-হাদীসের বর্ণনা সীমিত অথচ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিষয় সামনে আসছে আমাদের। আর একই বিষয়ে কোরআন-হাদীসের আলোকে সকল আলেমরা একমত পোষণ করবেন, এক দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখবেন, এটি স্বাভাবিক চিন্তার বাহিরে। কিন্তু এই মতপার্থক্য নিয়ে ঝগড়ার কোনো সুযোগ নেই।
আর এই ধরনের মতপার্থক্য রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগেও হয়েছিল।
সহীহ বুখারীর ৮৯৯ নং হাদীসে এই রকম একটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।
ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. আহযাব যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পথে আমাদের বললেন, বনূ কুরাইযা এলাকায় পৌঁছার আগে কেউ যেন আসরের সালাত আদায় না করে। কিন্তু অনেকেরই পথিমধ্যে আসরের সময় হয়ে গেল। তখন তাদের কেউ কেউ বললেন, ‘আমরা সেখানে না পৌঁছে সালাত আদায় করব না।’ আবার কেউ কেউ বললেন, ‘আমরা সালাত আদায় করে নিব। আমাদের নিষেধ করার এ উদ্দেশ্য ছিল না।’ (বরং উদ্দেশ্য ছিল তাড়াতাড়ি সেখানে যাওয়া।) রাসুলুল্লাহ সা. এর সামনে বিষয়টি উল্লেখ করা হলে তিনি কারো সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন নি।
এই হাদিস থেকে দেখা যায়, কোরআন-হাদীসের মর্ম বুঝার ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হতে পারে কিন্তু এটা নিন্দনীয় নয়। কেননা, এখানে সবার উদ্দেশ্যেই থাকে কোরআন-হাদীসের অনুসরণ।
তেমনি, সহীহ বুখারীর ২২৫০ নং হাদিসেও এই ধরনের আরেকটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে একটি আয়াত পড়তে শুনলাম। অথচ আমি রাসুলুল্লাহ সা. কে (আয়াতটি) অন্যরূপে পড়তে শুনেছি। আমি তার হাত ধরে তাকে রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে নিয়ে এলাম। তিনি বললেন, ‘তোমরা উভয়েই ঠিক পড়েছ। তোমরা বাদানুবাদ কর না। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা বাদানুবাদ করে ধ্বংস হয়েছে।’
এই হাদীস থেকেও মতপার্থক্য বিদ্যমান থাকাটা দোষণীয় না হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। সাথে সাথে এটাও বুঝা যায়, মতপার্থক্য থাকলে সেটা নিয়ে বাদানুবাদ করা যাবে না। ঝগড়া-বিবাদ করা যাবে না।
যাই হোক, উম্মতের সবচেয়ে বিজ্ঞ আলেমরা, যাদের আমরা ইমাম বলি, তারা কোরআন-হাদীস থেকেই যাবতীয় মাসআলা বের করেছেন। আর এই মাসআলার সংকলনই হল মাযহাব। অনেক বড় বড় আলেম এই মাযহাব প্রণয়নের কাজটি করে গেছেন। যদিও চার ইমাম ছাড়া অন্য কোন ইমামের মাযহাব তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করেনি এবং কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
ইমাম বুখারী র. যাকে আমরা সবাই চিনি হাদীস সংকলক হিসাবে তিনি নিজেও মাযহাব প্রণয়ন করেছেন। কিন্তু হাদীস শাস্ত্রে তার কথা সবাই মেনে নিলেও কোরআন হাদীস থেকে তিনি যেই সকল মাসআলা বের করেছেন, সেগুলো প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। ইমাম বুখারি রহ. যে কোরআন-হাদীস থেকে বিভিন্ন মাসআলা বের করার চেষ্টা করেছেন, এটা সহীহ বুখারী পড়লেই কারো সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি মাসআলায় দুইটি ভিন্নধর্মী হাদীস পাওয়া যায়, যার উভয়টাই সহীহ। কিন্তু সেখানে ইমাম বুখারী রহ. তাঁর কিতাবে শুধুমাত্র সেই হাদীস এনেছেন, যেই হাদীস তার মতের অনুকূলে।
এই রকম বড় বড় অনেক আলেমই মাযহাব প্রণয়ন করেছেন। কিন্তু চার মাযহাব প্রসিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর এবং উম্মতের সকলই এগুলোর কোনো না কোনোটা গ্রহণ করার পরেও এক শ্রেণীর লোক নতুনভাবে কোরআন-হাদীস থেকে মাসআলা বের করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ইলমি যোগ্যতা ও কোরআন-হাদীস অনুধাবনে তারা পূর্ববর্তীদের ধারে কাছেও ছিলেন না। তাদের এই চেষ্টা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। তাই চতুর্থ হিজরী শতাব্দীতে এসে উম্মতের বড় বড় আলেমরা একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত দেন যে, আর কোনো মাযহাব প্রণয়নের প্রয়োজন নেই।
কথিত আহলে হাদীসদের প্রশ্ন অর্থাৎ, ‘কোরআন হাদীস মান নাকি মাযহাব মান?’ সেই প্রশ্ন যে একেবারই ভিত্তিহীন, উপরের আলোচনায় সেটা সুস্পষ্ট। কিছু শব্দ পাশাপাশি বসালে যেমন বাক্য হয়ে যায় না, বাক্যের অর্থও থাকতে হয়। তেমন একটা প্রশ্ন করে দিলেই সেটা প্রশ্ন হয়ে যায় না।
‘গিতা পড় না কোরআন পড়?’ এটা একটা প্রশ্ন। কিন্তু ‘ঢাকায় থাক না বাংলাদেশে?’ এটা তো প্রশ্ন হতে পারে না। তেমনি, ‘কোরআন হাদিস মান না মাযহাব মান?’ এটা এই দ্বিতীয় প্রকারেরই প্রশ্ন। কেননা, মাযহাব কোরআন হাদিস থেকে ভিন্ন কোন জিনিস নয়। বরং কোরআন হাদিসের সারনির্যাসই হল মাযহাব।

কথিত আহলে হাদীসরা আরেকটি প্রশ্ন করে,

‘মাযহাব যদি কোরআন হাদিসের অংশই হয়ে থাকে তাহলে এর নাম হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ইত্যাদি কেন? কেন এক সাথে চার মাযহাব মানার সুযোগ আপনারা দেন না?’

এই ধরনের প্রশ্ন যারা করে, তাদের মূর্খতা তাদের প্রশ্নের দ্বারাই বোঝা যায়। ইমাম বুখারী রহ. সহিহ হাদিসের সংকলন করেছেন, ইমাম মুসলিম রহ.-ও একই কাজ করেছেন। এ কারণে তাদের সংকলিত হাদীসের কিতাব তাদের নামে প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে। তেমনি যারা মাসালাসমূহ সংকলন করেছেন, তাদের সংকলন (যেটি মাযহাব নামে পরিচিত), তাদের নামে প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে। এটাতে প্রশ্ন আসে কীভাবে?
আর চার মাযহাব একসাথে এই কারণেই মানার সুযোগ দেওয়া হয় না তাহলে মানুষ খেয়াল-খুশিমত ইসলামী বিধান মানবে। তাই বলা হয়, ‘যেই মাযহাবের ব্যাখ্যা তোমার নিকট অধিক যুক্তিসংগত, এমন একজনকেই তোমার মানতে হবে।’ ইসলাম আনুগত্যের নাম, খেয়াল-খুশিমত চলার নাম নয়।
যেমন, উপরে বলা হয়েছিল যে একটি হাদিসের ব্যাখ্যায় মতপার্থক্যের কারণে ইমামদের মাঝে মতভেদ হয়ে গেছে অযুতে নিয়ত শর্ত কিনা এবং এটাও বলা হয়েছিল যে, হানাফি মাযহাব মতে শর্ত নয় আর শাফেয়ী মাযহাব মতে শর্ত।
এখন একজন অযুর নিয়ত না করেই গোসল করার পর নামায পড়তে গেল। বলল, মতবিরোধপূর্ণ মাসআলায় আমি হানাফিদের অনুসরণ করি। একটু পর তার শরীর থেকে যেকোনো কারণে রক্ত বেরিয়ে গড়িয়ে পড়ল। এক্ষেত্রে হানাফি মাযহাব অনুসারে তার অযু ভেঙ্গে যাবে কিন্তু শাফেয়ী মাযহাব অনুসারে তার অযু ভাঙ্গবে না। সে যদি বলে, ‘এই মাসআলায় আমি শাফেয়ী মাযহাবের অনুসরণ করি। আমার অযু নষ্ট হয়নি।’ তাহলে কি ইসলাম আনুগত্যের পর্যায়ে থাকবে না তামাশায় পরিণত হবে?
তাদের আরেকটি প্রশ্ন হল, ‘রাসুল্লাহ সা. এর যামানায় তো মাযহাব ছিল না। তাহলে কি মাযহাব অনুসরণ বিদআত নয়?’
তাদের এই প্রশ্নটাও মূর্খতামূলক। কেননা, রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগে দুই মলাটে কোরআন লিপিবদ্ধ ছিল না, কোরআন অক্ষরগুলোর উপর হরকত লাগানো হয়নি, বুখারি, মুসলিম, তিরমিযি ইত্যাদি হাদিসের কিতাব ছিল না। তাহলে কি এগুলো বিদআত? আসলে যারা মাযহাবকে বিদআত বলে, তারা বিদআতের সংজ্ঞাই বুঝেনি।
বিদআত বলা হয়, ইসলামে নেই, এমন কোনো বিষয় ইসলামের অন্তর্ভুক্ত করাকে। যার কথা কোরআন হাদীসে নেই অথচ স্বতন্ত্রভাবে সেই কাজটিকে সওয়াব লাভের কারণ মনে করা হয়।(যদিও কাজটা বৈধ হয়ে থাকে) কিন্তু ইসলামী হুকুম পালনের জন্য কোন মাধ্যম অবলম্বন বিদআত নয়।
রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগেও কোরআন শরীফ ছিল কিন্তু অনারবিদের জন্য তা পড়া ছিল কষ্টের। তাই কোরআন শরীফে হরকত লাগানো হয়েছে। কোরআন শরীফ সহজে পড়ার মাধ্যম এই হরকত। তাই এটা বিদআত নয়।
রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগ থেকে মানুষ হাদিস সংরক্ষণ শুরু করে। কিন্তু সকলের নিকট সহিহ সূত্রে বর্ণিত হাদিস পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে কোন কিতাব লেখা বিদআত নয়।
তেমনি, ইসলামী বিধি-বিধান রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগ থেকেই ছিল। সেগুলো সংকলন করা বা মাযহাব প্রণয়নও কোন বিদআত নয়। কেননা, সওয়াবের উদ্দেশ্যে কেউ মাযহাব মানে না। বরং মাযহাব মানা হয় কোরআন-হাদীস অনুসারে যথার্থভাবে আমল করার মাধ্যম হিসাবে।

তাদের দাবির বাস্তবতাঃ

তারা দাবি করে যে, ‘আমরা ফিকাহ মানি না। মাযহাব মানি না। আমরা শুধুমাত্র কোরআন হাদিস মানি এবং সেই অনুযায়ী আমল করি।’
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কেননা, যারা এগুলো বলে তাদের মধ্যে বেশীরভাগই কোরআন হাদিস থেকে মাসআলা বের করতে সক্ষম নয়। বরং তারা আমল করার ক্ষেত্রে কারো না কারো মাযহাব ঠিকই মানে।
হ্যাঁ, তবে মাযহাব মানা আর আমাদের মাযহাব মানা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা, আমরা মানি এমন যুগের লোকদের মাযহাব যেই যুগের উত্তমতার বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সা. বলে গিয়েছেন। যাদের ইলমে দ্বীনের গভীর জ্ঞান এবং খোদাভীরুতার কথা ইতিহাসের পাতায় আজও সমুজ্জ্বল। আর তারা মানে এমন লোকের মাযহাব যারা বর্তমান যুগের লোক। যাদের অনেকেই ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। নিজে নিজে কিছু অনুবাদ পড়ে বড় পণ্ডিত সেজে বসে আছে। এমনকি সূরা ফাতেহা সহীহ শুদ্ধরূপে তিলাওয়াত করতে পারে না।
তাছাড়া আরও পার্থক্যও আছে। যেমনঃ আমরা অপর মাযহাবের লোকদের ভ্রান্ত বলি না এবং তাদেরকে আমাদের মাযহাবের দিকে দাওয়াতও দেই না। কিন্তু তারা তাদের মতের বাহিরের সবাইকেই ভ্রান্ত মনে করে। তাদের মতের পক্ষে মানুষদের দাওয়াত দেয়। যদি তাদের মতের বিপক্ষে কোন সহিহ হাদীসও থাকে, তাহলে তারা সেই সকল হাদিসকেও জাল বা দুর্বল দাবী করে সেই হাদিসকে অস্বীকার করে।
তাদের আরেকটি দাবি হল যে,

মাযহাব মানার কারণে ইসলামে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। মাযহাব না মানলে এই বিভক্তি দূর হয়ে যাবে।

কিন্তু তাদের এই মতটাও ঠিক না। কেননা শাগাগত বিষয়ে মতপার্থক্য আর কোরআন কারীমে যে বিভক্তি থেকে বারণ করা হয়েছে সেটা এক না। আর যদি ধরেও নেওয়া হয়, উভয়টা এক এবং হারাম। তাহলে যারা মাযহাবের অনুসারী না বলে নিজেদের দাবি করে, তারাও এই হারাম কাজে লিপ্ত।
বাংলাদেশে যারা মাযহাবের অনুসরণ করে না, তাদের মধ্যেও অনেক ভাগ আছে, অনেক মতপার্থক্য আছে। যেমন, বাংলাদেশে তাদের মধ্যে বড় ধরনের দুইটি দল আছে। একদলের দাবি, সৌদিতে যেদিন চাঁদ দেখা যাবে, সেদিন বাংলাদেশেও ঈদ পালন করতে হবে। এদের বলা হয় ‘সৌদি পক্ষ’। আর আরেক দলের মত, যেদিন বাংলাদেশে চাঁদ দেখা যাবে, সেদিনই বাংলাদেশে ঈদ হবে। এদের বলা হয় ‘চাঁদ পক্ষ’। ২০১৪ সালের ১০ই অক্টোবর ময়মনসিংহ সদর উপজেলার দাপুনিয়া গোষ্টা মার্কাস মসজিদে এ বিতর্ক অনুষ্ঠান হয়। যেই বিতর্কে বিজয়ী হয় চাঁদ পক্ষ। তাদের এই বিতর্কই প্রমাণ করে যে, মাযহাব না মানলেই মতপার্থক্য দূর হয়ে যায় না।

তাদের দাবি মেনে নিলে যা হতঃ

‘কারো সংকলন করে দেওয়া মাসআলা মানা যাবে না। বরং নিজেই কোরআন হাদিস দেখে মাসআলা বের করতে হবে।’
যদি তাদের এ দাবি মেনে নেওয়া হত তবে বাংলাদেশের মানুষসহ সব অনারবিদের প্রথমে আরবী ভাষা শিখতে হত। কেননা, এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় কখনোই যথার্থ অনুবাদ সম্ভব নয়।
‘আর যদি কোরআন হাদিসের অনুবাদের ক্ষেত্রে আপনি অন্যের উপর নির্ভর করতে পারেন তবে কোরআন হাদিস থেকে মাসআলা বের করার ক্ষেত্রে কেন আপনি বিজ্ঞ আলেমদের উপর নির্ভর করতে পারবেন না?
তাদের এই দাবির দ্বারা আলেমদের প্রতি আস্থাহীনতাও প্রমাণিত হয়।
এখন যদি আলেমদের থেকে দূরে সরে গিয়ে তারা নিজেরাই কোরআন হাদীস পড়া শুরু করে এবং সেগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করে, তবে যে বিরাট ফিতনা-বিশৃঙ্খলা শুরু হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, আলেমরা যখন কোন কিছুর ব্যাখ্যা দেন, তখন কোরআন হাদিসের সমস্ত জ্ঞানকে সামনে রেখে এর ব্যাখ্যা দেন। আর সাধারণ মানুষ যখন হাদিস ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে, তখন তার সামনে একটি হাদিস আসলে সে সেটা না বুঝেই নিজের মনমত ব্যাখা দেওয়া শুরু করে দিবে।
তাছাড়া, অনেক হাদিস আছে যেগুলো বিজ্ঞ আলেমদের ব্যাখ্যা ছাড়া জনসাধারণের বুঝে আসবে না। এখন যদি তারা আলেমদের থেকে দূরে সরে যায়, তাহলে তারা এই সব হাদিসের প্রশান্তিমূলক ব্যাখ্যা না পেয়ে অস্থির হয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের বাঁচাক, এই অবস্থায় এসে  অনেক মানুষ হাদিস অস্বীকারকারী কিংবা নাস্তিক হয়ে যায়। আর এ ধরনের ঘটনা আমাদের চারপাশে অহরহ ঘটে চলছে।

Facebook Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *