ধর্মত্যাগী কেন ধর্মত্যাগের পথে পা বাড়ায়?
সেটাই ব্যাখ্যার চেষ্টা করব আজকের এই লেখাটিতে ইনশাআল্লাহ্।
আর ব্যাখ্যার কাজটা করব একটি হাদীসের সাহায্যে।
আবূ হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কতিপয় সাহাবী তাঁর সমীপে এসে বললেন, আমাদের অন্তরে এমন কিছু সংশয়ের উদয় হয়, যা আমাদের কেউ মুখে উচ্চারণ করতেও মারাত্মক মনে করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেনঃ সত্যই তোমাদের তা হয়? তারা জবাব দিলেন, জ্বী, হ্যাঁ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এটাই স্পষ্ট ঈমান। (মুসলিম-২৪০)
এখন আমরা হাদীসের কয়েকটি অংশ লক্ষ্য করি।
১. সাহাবায়ে কেরামের মনে কিছু সংশয়ের উদয় হয়। এমন সংশয়ের উদয় হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে দামি বস্তু হচ্ছে ঈমান। যেই ঈমানের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতী হতে পারে। তাই শয়তান সর্বদাই চেষ্টা করে ঈমানের বিষয়ে মানুষের মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করতে। যেমন বর্ণিত হয়েছে কোরআন কারীমের ভাষায়ঃ
সে (শয়তান) বললঃ আমাকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন।
আল্লাহ বললেনঃ তোকে সময় দেয়া হল।
সে বললঃ আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকবো। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না। (সুরা আরাফ- ১৪-১৭)
মানুষের মনে সন্দেহ আসতেই পারে। আসার পর সাহাবায়ে কেরাম কী করলেন?
২- প্রিয়নবী সা.-এর কাছে এসে বললেন, আমাদের অন্তরে এমন কিছু সংশয়ের উদয় হয়, যা আমাদের কেউ মুখে উচ্চারণ করতেও মারাত্মক মনে করে। তাদের সেই সংশয়গুলো মুখে আনা মারাত্নক মনে করার কারণেই নবীজি সা. তাদের প্রশংসা করে বললেন, এটাই স্পষ্ট ঈমান।
এখান থেকে যা বুঝা যায় কোন সন্দেহ মনে আসলেই তা কারো নিকট প্রকাশ করা উচিৎ নয়। কারণ অনেক সময় এমন হয় যে, এসব সন্দেহ আল্লাহর রহমতে খুব সহজেই মন থেকে দূর হয়ে যায়। কিন্তু যদি সেগুলো আপনি কারো সাথে আলোচনা করেন, তাহলে সহজে আর সেই সংশয় দূর হবে না।
উদাহরণত আপনি ইচ্ছা করলেন, আপনি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারের চেষ্টা করবেন। এটা আপনার মাঝেই থাকলো। কিন্তু আপনি যদি আপনার চাওয়াটা সবার সামনে প্রকাশ করে ফেলেন, তখন আর সেটা ছোট ব্যাপার থাকে না। আপনার মনে তখন থেকেই হয়ত এই চিন্তা কাজ করবে যে, আমি তো সবাইকে বলে ফেললাম। কিন্তু পরীক্ষায় যদি প্রথম না হতে পারি তাহলে কী অবস্থা হবে?
তাই তো প্রিয়নবী সাঃ বলেছেন, এই ধরণের প্রশ্ন মনে আসলে তা ঝেড়ে ফেলে দিতে, কারো কাছে প্রকাশ না করতে এবং ‘আউযুবিল্লাহ’ ও ‘আামানতু বিল্লাহ’ পড়তে।
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ শয়তান তোমাদের কারো কাছে আসে এবং বলে, এটা কে সৃষ্টি করেছে, ওটা কে সৃষ্টি করেছে? পরিশেষে এ প্রশ্নও করে, কে তোমার রবকে সৃষ্টি করেছে? এই পর্যায়ে পৌছলে, আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো (আউযুবিল্লাহ পড়) এবং এ ধরনের ভাবনা থেকে বিরত হও। (মুসলিম-২৪৫)
আবূ হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ মানুষের মনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়। এক পর্যায়ে এমন প্রশ্নেরও সৃষ্টি হয় যে, এ সৃষ্টি জগততো আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, তাহলে কে আল্লাহ কে সৃষ্টি করেছে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যার অন্তরে এমন প্রশ্নের উদয় হয়, সে যেন বলে, (আমানতু বিল্লাহ) “আমি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি।” (মুসলিম-২৪৩)
আবূ হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ কথা বা কাজে পরিণত না করা পর্যন্ত আল্লাহ জন্য আমার উম্মতের মনের কল্পনাগুলো মাফ করে দিয়েছেন। (মুসলিম-২৩১)
৩. তৃতীয় যে বিষয়টা আমরা হাদীস থেকে লক্ষ্য করি।
সেটা হল, সন্দেহ-সংশয় জন্ম নেওয়ার পর তারা প্রিয়নবী সা. এর কাছে ছুটে গিয়েছেন। বস্তুত এমনটাই হওয়া উচিৎ। যখনই মনে কোন খটকা তৈরি হবে এবং আপনি তা কিছুতেই মন থেকে দূরে সরাতে পারবেন না, তখনই কোন আমলী বিজ্ঞ আলেমের নিকট যাওয়া উচিৎ। এখানে যদি আপনি প্রসিদ্ধ পীর, বড় জুব্বাওয়ালা কোন মূর্খ আলেমের কাছে যান তাহলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। তাই এমন কারো কাছে গেলে আপনি উপকার পাবেন যিনি দুনিয়াবিমুখ, বিজ্ঞ এবং উত্তম আমল ও চরিত্রের অধিকারী।
সাহাবায়ে কেরাম যখনই কোন বিষয়ে পেরেশান হতেন তখনই তারা ছুটে যেতেন নবীজি সা. এর কাছে। উনার কয়েকটি কথাতেই সমস্ত পেরেশানি দূর হয়ে যেত।
হানযালা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ছিলাম। তিনি আমাদের ওয়ায-নসীহত করলেন এবং জাহান্নামের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি বলেন, তারপর আমি বাড়ীতে আসলাম এবং ছেলে-মেয়েদের সাথে হাসি-তামাশা করলাম এবং স্ত্রীর সাথে ক্রীড়া-কৌতুক করলাম। এরপর আমি বাড়ি থেকে বের হলাম। তখন আবূ বাকর রা. এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। আমি তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করলাম। তিনি বললেন, আমিও তো এরূপ করেছি, যেমন তুমি বললে।
তারপর আমরা উভয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! হানযালা তো মুনাফিক হয়ে গিয়েছে। তিনি বললেনঃ তা কী? তখন আমি আমার পুরা অবস্থা বর্ণনা করলাম। এরপর আবূ বাকর রা. বললেন, আমিও তো এরূপ করেছি যেমন হানযালা করেছে। তিনি বললেন, হে হানযালা! ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে। ওয়ায-নসীহতের সময় তোমাদের হৃদয় যেমন থাকে, সর্বদাই যদি তা এ অবস্থায় থাকতো তবে ফিরিশতাগণ অবশ্যই তোমাদের সঙ্গে মুসাফাহা করতো। এমনকি পথে ঘাটে তারা তোমাদের সালাম করতো। (মুসলিম – ৬৭১৪)
এই হাদীসে কী সুন্দর ভাষায় নবীজি সা. তাদের মনের অশান্তি দূর করে দিলেন। আমাদের উচিৎ তাই এমন কোন বিজ্ঞ এবং আমলি আলেমের সান্নিধ্যে থাকা, যার কাছে গেলে আমাদের মনের অশান্তি দূর হবে। আমরা ঈমান ও আমলের প্রতি উৎসাহিত হব। এই সান্নিধ্য সরাসরি লাভ করাটাই সবেচেয়ে উত্তম। তবে সেটা সম্ভব না হলে সান্নিধ্য অর্জন হতে পারে তাঁদের লিখিত বইপত্র অধ্যয়ন অথবা বর্তমান সময়ে অনলাইনে তাঁদের ওয়াজ শোনার মাধ্যমে।
رَضِيتُ بِاللَّهِ رَبًّا، وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولاً
রব হিসেবে আমি আল্লাহকে পেয়ে সন্তুষ্ট। দ্বীন হিসেবে ইসলাম পেয়ে সন্তুষ্ট। নবী হিসেবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেয়ে আমি সন্তুষ্ট।
Facebook Comments