জামায়েতে ইসলাম এবং আমার উপলব্ধি।

জামায়েতে ইসলাম
জামায়েতে ইসলাম নামক দলটির কর্মীদের সাথে আমার প্রথম কথা হয় খেলার মাঠে। খেলছিলাম, এমন সময় ‘কিশোর কণ্ঠ’ নামক পত্রিকার কতগুলো পুরনো কপি নিয়ে এসেছিল একদল তরুণ। পত্রিকাগুলো ফ্রি বিলি করে তারা আর সবার সাথে যোগাযোগের উপায় লিপিবদ্ধ করে নিয়ে যায়। তারপর পত্রিকাগুলো বাসায় নিয়ে আসার পর জানতে পারি, এটা জামাতিদের পত্রিকা। জামাত ভ্রান্ত দল ইত্যাদি। কিন্তু কেন ভ্রান্ত, সেটা তখনো জানার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
আমি আমার কৈশোরের কথা বলছি। তারপর একদিন শিবিরের কর্মীর সরাসরি দাওয়াত। আমি শুধু এটুকু বললাম যে, আপনারা ভ্রান্ত। আপনাদের দলে আমি যোগ দিব না। তখন সে যা বলেছিল এখনো মনে ভাসে।
‘ইসলাম শুধু নামায-রোযার নাম না। ইসলাম একটি সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা ইসলামকে নামায-রোযার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। এখন জামায়াত চায়, সব স্তরে ইসলাম কায়েম করতে। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী বিচার করে না সে কাফের। তাই তারা কুফরির আওতায় এসে যায় যারা জামায়াতে ইসলামের বিরোধিতা করছে। কারণ, প্রকারন্তরে যেন তারা আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার পথে বাঁধা সৃষ্টি করে কুফরি করেছে।’
কথাগুলো আমার মনে প্রভাব ফেলেছিল। আমি অন্তর থেকে তাদের বক্তব্য গ্রহণ করতে পারিনি। কারণ বড় বড় আলেমদের দেখছিলাম যে তারা জামাতের বিরোধিতা করে আবার ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠাও করতে চায়। তাই বুঝলাম যে, তাদের গলদ অন্য জায়গায়। যেটা সে কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছে। তাই জানার চেষ্টা করতে থাকি কেন আলেমরা তাদের বিরোধিতা করছে।
আমি তখন মাদানী নেসাব দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কিন্তু তখনই জানার তীব্র আকাঙ্খায় একে একে পড়ে ফেলি ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ, ভুল সংশোধন এবং আরও অনেক কিতাব যাতে জামাতের বিভ্রান্তিগুলো তুলে ধরা হয়েছে। যে মূল বক্তব্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে জামাতের বিভ্রান্তির কারণ হিসেবে তা সংক্ষেপে যদি বলি, তাহলে তালিকাটা এমন।
১. দ্বীনের তারতিবে পরিবর্তন।
২. নবী-রাসূলদের দ্বারা গোনাহের সংঘটিত হওয়ার উক্তি।
৩. আদালতে সাহাবাকে অস্বীকার।
৪. ইসলামী পোশাক হিসেবে পরিচিত পোশাককে তুচ্চ করা।
৫. শিয়াদের বিভিন্ন অংশকে গ্রহণ করে নেওয়া। যেমন, তাদের মিথ্যা ইতিহাসে আস্থা রাখা, দলীয় প্রয়োজনে মিথ্যা বলাকে বৈধ মনে করা ইত্যাদি।
কিন্তু ঝামেলা হল, এই পর্যন্ত আমি যত জামাত-শিবিরের কর্মী অথবা তাদেরকে পছন্দ করে এমন ব্যক্তিদের এই কথাগুলো বুঝিয়ে জামাত থেকে দূরে রাখতে চেয়েছি। একজনের ক্ষেত্রেও সক্ষম হইনি। যদিও বিভিন্ন ভ্রান্ত ফিরকার মানুষকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে তাদের ভ্রান্ত আকিদা থেকে ফেরাতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ্‌।
একটা কথা অপ্রাসঙ্গিকভাবে হলেও বলি যে, আমি শিরক থেকে দূরে আছে এমন সব দলের লোকদেরকে ভালবাসি। হোক সেটা চরমোনাই, তাবলীগ, আহলে হাদীস, জামায়াত, জমিয়ত বা অন্য কোন বাহ্যত শিরক মুক্ত দল বা প্রতিষ্ঠান। কারণ, আমি দেখেছি যে, নিচু সারির অধিকাংশ কর্মীর মাঝে ইখলাস রয়েছে। তাদের ইখলাসের প্রতি আমার পূর্ণ সম্মান রয়েছে এবং আন্তরিকভাবে চাই যে একদিন যেন সমস্ত ফিরকার মাঝে ইখতলাফ দূর হয়ে ই’তিসাম বিহাবলিল্লাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার রহিমুল্লাহের একটা কথা আমার খুব ভালো লাগত যে, একটা দলকে বিবেচনা করতে হবে তাদের সামগ্রিক কাজ দিয়ে। দুই একটা ভুল দিয়ে নয়।
তো যাই হোক, মূল কথায় ফিরে আসি।
জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে আমাদের যে অভিযোগ সেগুলো শুনার পরেও তাদের দল থেকে কেউ ফিরে না কেন?
আমার দুইটা অভিজ্ঞতা হয়েছে এই বিষয়ে।
১. যখন তারা অভিযোগটা শুনে তখন তারা তাদের দলীয় নেতাদের কাছে যায়। বিষয়টা আলোচনা করে। নেতারা তাদের বলে যে, এগুলো মওদুদি রহঃ এর আসল বক্তব্য নয়। এগুলো তার বক্তব্যের কাটছাঁট করা খণ্ডিত অংশ।
সত্যি বলতে কি তাদের এই কথা যদি সত্যি হত তাহলে আমি অনেক আনন্দিত হতাম। কারণ এতবড় একটি সংগঠন ভ্রান্তির উপর নেই, ভাবতেই মনটা আনন্দময় হয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার তাদের নেতারা তাদের কর্মীদের মিথ্যা বলে। সত্য হয় প্রকাশিত হয় তারা দ্বিতীয় যে কাজটি করে সেটির দ্বারা।
২. তাদের দলের দ্বিতীয় আরেকটি অংশ রয়েছে যারা মওদুদী রহ.-এর ভুল বক্তব্যগুলোকেও সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করে। এতেই প্রমাণিত হয় যে, আমরা কাটছাঁট বক্তব্য প্রকাশ করছি না।
তাদের কয়েকজনের লেখা পড়ি নিয়মিত। যাচাইও করলাম। যা উপলব্ধি করলাম তা হল, আমরা যে অভিযোগ করি সেগুলর মধ্যে ইসমতে আম্বিয়া, আদালতে সাহাবা, ইসলামী পোশাককে তুচ্চ করা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে সম্ভবত সালাফদের মাঝেও কিছুটা মতভেদ রয়েছে বা তাদের নিজেদের কথা ভুল না এটা প্রমাণ করার পক্ষেও যুক্তি দাড় করানোর সুযোগ রয়েছে। জামায়াতের সমর্থকরা যখন লেখাগুলো পড়ে তখন তৃপ্তি লাভ করে এই ভেবে যে, নাহ! আমরা ভুলে নেই।
তাহলে তাদের সমর্থকদের ফিরানোর বা বুঝানোর উপায়টা কী?
তাদের কথাগুলোর সবচেয়ে ঈমানবিধ্বংসী যেই বিষয় সেটা তুলে ধরা। একবাক্যে যেটাকে তুলে ধরা যায় এভাবে, জামায়াতে ইসলামের লোকদের এমন কিছু কথা প্রকাশ পায় যার দ্বারা হাদীস শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়।
তারপর ব্যাখ্যা এভাবে আনা যায় যে, ইসলামের মূল হচ্ছে কোরআন যেটা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা নবীয়ে কারীম সল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করেছেন। যেই ব্যখ্যা সংকলিত হয়েছে হাদীসে। কোরআন শরীফে যেমন বলা হয়েছে, তোমরা সালাত কায়েম কর। যার ব্যাখ্যা আমরা জানতে পেরেছি হাদীসের মাধ্যমে। কিভাবে সালাত কায়েম করতে হবে। সালাতের মূল অর্থ দোয়া। এখন যদি কেউ দোয়ার মজলিস প্রতিষ্ঠা করে বলে যে আমি সালাত কায়েম করেছি তাহলে তার বক্তব্যের ভুলটাও আমরা জানতে পারব এই হাদীসের মাধ্যমে। এখন জামাত কিন্তু হাদীস সরাসরি অস্বীকার করে না। তবে তাদের এমন বক্তব্য রয়েছে যার দ্বারা হাদীস শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়।
১. তারা দাবি করেন যে, সনদ শুদ্ধ হলেই হাদীস শুদ্ধ হয়ে যায় না। সনদ শুদ্ধ হওয়ার পর দেখতে হবে যে হাদীসের বক্তব্য আমাদের বুঝে আসে কিনা? যদি না বুঝে আসে তাহলে বুঝতে হবে হাদীসের মধ্যে ভুল রয়েছে। হাদিসটা শুদ্ধ নয়। অথচ এভাবে বললে, বায়ুত্যাগের কারণে অযু আবশ্যক হওয়ার হাদীসকেও ভুল বলা যাবে। কারণ বাহ্যত এটা বুঝে আসে না যে, বায়ুত্যাগের স্থান কেন ইসলাম অন্য স্থান ধৌত করার আদেশ দিবে।
২. সমস্ত হাদীসের নির্ভরযোগ্যতার ভিত্তি হচ্ছে সাহাবায়ে কেরামের সততা। এখন যদি সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা করা হয়, তাদের সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় তাহলে হাদীসের নির্ভরযোগ্যতার ভিত্তিই নষ্ট হয়ে যায়।
আরেকটি কথাও প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে ইচ্ছা করেছে সেটা হল জামাতিদের যে মূল ভুলগুলো সেগুলো আহলে হাদীসদের মাঝে নেই। তাই যখন তারা দেওবন্দি উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব দাঁড় করানোর অংশ হিসেবে আহলে হাদীসদের এই দেশে পরিচিত করে এবং এর প্রভাবে নিজেরাই দলে দলে আহলে হাদীস হয়ে যায় তখন আমার মনটা আনন্দিতই হয়। যদিও অনেক আহলে হাদীসের মানহায ভালো না, তাদের মাঝে ভুলও আছে এবং তাদের কিছু বেয়াদবির মাত্রা খারাপের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে কিন্তু দিনশেষে তাদের মাঝে ঐ পরিমাণ ভ্রান্তি নেই যা জামায়েতে ইসলামের মাঝে রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের সবার থেকেই সমস্ত ভ্রান্তি দূর করে দেন।

Facebook Comments

2 Comments

  1. আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়াত দান করুন আর জামাতিদের তাদের ভ্রান্ত আক্বিদা থেকে ফিরে আসার তাওফিক দান করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *